যথাসময়ে শুরু হলো সিদ্ধার্থ গৌতমের বিদ্যাশিক্ষা। সে সময়ে ৬৪ রকম লিপির প্রচলন ছিল। গুরুর সান্নিধ্যে তিনি প্রচলিত লিপি সম্পূর্ণ আয়ত্ত করেন। ক্রমে তিনি বেদ, পুরাণ, ইতিহাস, যোগ, ন্যায়, গণিত ও চিকিৎসাবিদ্যা শেখেন। ক্ষত্রিয় রাজকুমার হিসেবে তিনি শেখেন রাজনীতি, মৃগয়া, ধনুর্বিদ্যা, অশ্বারোহণ, রথচালনা ইত্যাদি। একবার তিনি শাক্য কুমারদের সঙ্গে রথচালনা প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছিলেন। প্রতিযোগিতায় একবারে জয়ের মুখে পৌঁছে রথের রাশ ছেড়ে দিয়ে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী দেবদত্তকে জয়লাভের সুযোগ করে দেন। এতে গৌতম খুব আনন্দ লাভ করেন। আর একবার শিকারে গিয়ে হাতের শিকার একটি হরিণ শাবককে ছেড়ে দিয়ে সঙ্গীদের বিরক্তি উৎপাদন করেন। কিন্তু হরিণ শিশুর প্রাণ রক্ষা হওয়ার আনন্দে তিনি অভিভূত হন। দুই ক্ষেত্রেই তিনি বন্ধুদের কাছে ধিক্কার লাভ করেন। আর একবার রোহিণী নদীতে বড় একটি গাছ পড়ে বাঁধের সৃষ্টি করল। এতে পানি চলাচলসহ নদীপথে যাতায়াতে সমস্যার সৃষ্টি হলো। তখন তিনি নিজ বুদ্ধিবলে তা অপসারিত করেন।
সিদ্ধার্থ গৌতমের বয়স ক্রমে বাড়তে লাগল। কৈশোর পেরিয়ে জীবন এগিয়ে চলছে। একদিন তিনি রাজপ্রাসাদ- সংলগ্ন উদ্যানে চিন্তামগ্ন হয়ে বসে ছিলেন। এসময় একদল বুনো হাঁস সারি বেঁধে উড়ে চলেছে। তাদের ডানার শব্দে বন মুখরিত। তিনি অপলক নয়নে তাকিয়ে আছেন মুক্ত পাখিদের চলার দিকে। তাঁর মন আনন্দে ভরে উঠল।
হঠাৎ এই আনন্দের মাঝে এলো বিষাদের ঘনঘটা। একটি হাঁস তিরবিদ্ধ হয়ে নিচে পড়ে গেল তাঁর কোলের কাছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে হাঁসের সর্বাঙ্গ। গৌতমের মন বেদনায় কেঁদে উঠল। তাড়াতাড়ি মমতাভরে হাঁসটিকে তিনি তুলে নিলেন নিজের কোলে। সরিয়ে নিলেন হাঁসের বুকের তির। আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠল হাঁস।
হাসি ফুটল সিদ্ধার্থের মুখে। অমনি এসে উপস্থিত হলেন মামাতো ভাই দেবদত্ত। চিৎকার করে দেবদত্ত বলল- আমার শরে আহত পাখি, আমাকে দাও। সিদ্ধার্থ গৌতম কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, এই আহত পাখিকে সেবা করে আমি ভালো করে তুলেছি। এই পাখি আমার।
দেবদত্ত বললেন, একে আমি তিরবিদ্ধ করেছি। এর ওপর আমার অধিকার। গৌতম বললেন, প্রাণঘাতীর চেয়ে প্রাণদানকারীর দাবি বেশি। কাজেই এ পাখি আমার। শাক্যরাজ্যের বিনিময়েও এই হাঁস আমি কাউকে দেব না। আকাশের পাখি আকাশে উড়িয়ে দেব।
এতে ক্ষিপ্ত ও রাগান্বিত হলেন দেবদত্ত। তারপর বিচার বসল রাজদরবারে। গৌতমের এক কথা-প্রাণঘাতীর চেয়ে প্রাণদানকারী বড়। প্রাণদাতার দাবিই বেশি। তিনি আরও বললেন, আমার মতো এ পাখিরও প্রাণ আছে। আঘাত করলে তোমার ও আমার যেমন যন্ত্রণা হয়, ওরও তেমনি যন্ত্রণা হয়। কিন্তু ওর মুখে আমাদের মতো ভাষা নেই। মুখ ফুটে কথা বলতে পারে না। তবুও তুমি তাকে তির মারলে।
দেবদত্ত বললেন, তোমার এত কথার প্রয়োজন দেখি না। এই হাঁস আমি শরবিদ্ধ করেছি। কাজেই আমি এর একমাত্র দাবিদার।
বিচারে অবশেষে প্রাণদানকারীর জয় হলো। গৌতম দুই হাতে আদর করে আকাশের পাখি আকাশে উড়িয়ে দিলেন। আর যেতে যেতে পাখিটি গৌতমের দিকে তাকাতে লাগল।
বয়স কম হলেও পৃথিবীর যাবতীয় চিন্তা যেন গ্রাস করেছে সিদ্ধার্থ গৌতমকে। তিনি থাকেন সর্বদা চিন্তাশীল। রাজপ্রাসাদের ভিতরেও গৌতমের মন ভরে না। তাঁর আনন্দের জন্য রাজা শুদ্ধোদন নৃত্য, গীতসহ আনন্দের উপকরণের কিছুই বাকি রাখেননি। গৌতমের মন তাতে সন্তুষ্ট নয়। সুযোগ পেলেই তিনি কোনো অজানা চিন্তায় মগ্ন হন। রাজা শুদ্ধোদন এতে বিচলিত হয়ে পড়েন।
এ সময় রাজার বিচক্ষণ মন্ত্রীরা পরামর্শ দিলেন, কুমারের জন্য গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীতঋতু উপযোগী তিনটি প্রাসাদ তৈরি করতে হবে। শুদ্ধোদন তার ব্যবস্থা করলেন। ভোগ ও বিলাসের জন্য সব সুযোগ করে দিলেন। কিন্তু সিদ্ধার্থ গৌতমের কাছে সেসব ছিল মূল্যহীন। রাজকুমারের গভীর মৌনতা ও চিন্তামগ্ন স্বভাবে বিচলিত হয় রাজা ও রানির মন। তাঁরা কুমারের মনোভাব পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেন।
গৌতমের বয়স তখন ষোলো বছর। এ সময় রাজা শুদ্ধোদন ছেলেকে বিয়ে দিয়ে গৃহমুখী করতে চাইলেন। সেকালের রীতি অনুযায়ী ঠিক হলো গৌতম অশোকভান্ড বিতরণ করবেন। বিবাহযোগ্য রমণীরা উৎসবে এসে যে উপহার গ্রহণ করেন, তার নাম অশোকভান্ড। এই উপলক্ষ্যে রাজ্যের বিবাহযোগ্য সব শাক্যকুমারী গৌতমের হাত থেকে অশোকভান্ড উপহার গ্রহণ করবেন। কুমারের বিবেচনায় সেরা সুন্দরী গ্রহণ করবেন শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। শেষে সেই শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হবেন তাঁর স্ত্রী।
একে একে সব শাক্যকুমারী উপহার নিয়ে গেলেন। অশোকভান্ড শেষ। তারপর এলেন গোপাদেবী। কুমার গৌতম রাজঅঙ্গুরীয় দিয়ে বরণ করলেন গোপাদেবীকে। যিনি যশোধরা নামেও পরিচিত। সবাই বুঝলেন- গোপাদেবীই তাঁর মনোনীত বধূ। কিন্তু তারপরও গৌতমকে শক্তি ও বিদ্যার প্রমাণ দিতে হলো। সবার সামনে গৌতম প্রমাণ করলেন, তিনি সব শাস্ত্রে পারদর্শী। পুরাণ, ইতিহাস, গণিত, ধর্মনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি-সব বিষয়ে তিনি শ্রেষ্ঠ গণ্য হলেন।
তারপর শুভদিন শুভক্ষণে সারা রাজ্যে উৎসব হলো। বিয়ে হলো সিদ্ধার্থ ও গোপাদেবীর। রাজা শুদ্ধোদন ভাবলেন, রাজকুমার এবার সংসারী হবেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে তিনি হবেন নিশ্চিন্ত।
এদিকে রাজকুমারের মনে বিরাজ করে এক অজানা অনুসন্ধানী প্রত্যাশা। ক্রমে গৌতমের বয়স হলো উনত্রিশ বছর। বয়সের দিক থেকে তিনি এখন অনেক পরিণত। জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু তাঁকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি বুঝতে চেষ্টা করেন বিভিন্ন বিষয়। সংসারের অসারতা তিনি বুঝে ফেলেছেন। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তিনি আরও জানতে চান। এ সময় তাঁর জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় তাঁর জীবনের লক্ষ্য স্থির হয়ে যায়।
একদিন গৌতম ঠিক করলেন, নগর ভ্রমণে বের হবেন। রাজা শুদ্ধোদনও সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিলেন। পাশাপশি এই পদক্ষেপও নিলেন যে, যাতে কুমারের যাওয়ার পথে দুঃখ কষ্টের কোনো দৃশ্য না থাকে। যথারীতি কুমার একদিন তাঁর সারথি ছন্দককে বললেন, রথ সাজাও, আমি ভ্রমণে যাব। ছন্দক রথ সাজিয়ে আনলেন। প্রথমে যাত্রা করলেন পূর্ব দিকে। রাজার আদেশে চলছে চারদিকে আনন্দ, বাদ্য ও গীতধ্বনি। গৌতমের মনে হলো জগতে দুঃখ নেই, শোক নেই, কান্না নেই, হতাশা নেই। আছে আনন্দ, শোভা ও সুষমা। হঠাৎ গৌতম চিৎকার করে সারথিকে ডেকে বললেন, এ কোথায় নিয়ে এলে ছন্দক, কোন রাজ্যে আমরা রথে চড়ে ঘুরছি? ওই দেখো কে যায়? তার হাত কাঁপছে, পা টলছে, ঘাড় দুলছে। কে সে?
ঘোড়ার গতি থেমে গেল। বিষাদে ছেয়ে গেল ছন্দকের মন। তিনি বললেন, উনি এক বৃদ্ধ। বার্ধক্যের কারণে শরীরের এই জীর্ণ অবস্থা। গৌতম বললেন, সবার কি এই দশা হবে? আমারও?
ছন্দক বললেন, হ্যাঁ। সকলকে একদিন বৃদ্ধ হতে হবে।
অমনি গৌতম বললেন, ছন্দক, রথ ঘোরাও। আমি আজ ভ্রমণে যাব না। আমার মন ভালো নেই। রথ ফিরে এলো প্রাসাদে।
আর একদিন গৌতম ভ্রমণে বের হলেন। সেদিন আরও সর্তক হলেন রাজা। আবার ঘোষণা করে দিলেন রাজপথে যেন বৃদ্ধ বা অসুস্থ কেউ না যায়। কোনো দুঃখের দৃশ্য যেন গৌতমের চোখে না পড়ে। রথ ছুটে চলল। এবার দক্ষিণ দিকে। পথে পথে সুন্দরের সমারোহ, পাখির কাকলি, আনন্দের স্রোতোধারা। এমন সময় গৌতম দেখলেন এক অসুস্থ ব্যক্তি। দাঁড়াতে পারে না, চলতে পারে না। শরীর কাঁপছে, বেদনায় কাতর। কষ্টে হা-হুতাশ করছে।
গৌতম প্রিয় সারথিকে বললেন, রথ থামাও। ছন্দক! কে ওই লোক, কেন তার এত কষ্ট, কেন অমন করছে? রথ থামালেন ছন্দক। বললেন, উনি এক রোগী। অসুখে কষ্ট পাচ্ছেন।
গৌতম বললেন, সব মানুষই কি রোগের বশীভূত? আমারও কি এই দশা হবে? গোপাদেবীরও কি এই অবস্থা হবে? ছন্দক বুঝিয়ে দিলেন, জীবমাত্রেরই রোগ আছে। গৌতম সেদিনও নগরভ্রমণ বন্ধ করে রাজপ্রাসাদে ফিরে এলেন।
অন্য আর একদিন। এবার পশ্চিম দিকে চলল রথ। আনন্দের লহরি চলছে চারদিকে। এমন সময় তিনি দেখলেন, চারজনের কাঁধে এক শবাধার। পিছনে পিছনে চলছে কান্নারত বহু মানুষ।
গৌতম বললেন, ছন্দক, কে ওই শবাধারে? কেন এই শোক করছে? কেন ওরা কান্নায় মোহ্যমান?
হৃন্দকের হৃদয় অস্থির হলেও প্রিয় রাজকুমারকে সব বুঝিয়ে বলতে হলো। পরিচয় করিয়ে দিতে হলো জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি মৃত্যুর সঙ্গে
গৌতম আর ভ্রমণে গেলেন না। ফিরে এলেন রাজপ্রাসাদে।
আর একদিন বের হলেন উত্তর পথে। এবারও তাঁর চোখ খোলা, যদি দেখতে পান আনন্দের কিছু! এবার সত্যিই দেখলেন আনন্দের দৃশ্য। গৃহত্যাগী এক তরুণ সন্ন্যাসী। অরুণ বরণ তাঁর গায়ের রং। সৌম্য, দিব্য চেহারা। প্রসন্ন হাসি লেগে আছে মুখে। দুঃখের লেশমাত্র নেই চলার গতিতে ও মনে। গৌতম জিজ্ঞেস করলেন, ছন্দক! ইনি কে? দুঃখ তাঁকে কি স্পর্শ করে না? ছন্দক বললেন, তিনি সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী। তাঁর ঘরবাড়ি নেই। আত্মীয়স্বজনের মায়া তিনি ত্যাগ করেছেন। সব কিছু বুঝে ফেললেন গৌতম। সন্ন্যাসীর মধ্যে তিনি দেখতে পেলেন নিজেকে। জরা, ব্যাধি, মরণের কথাও মনে পড়ল সঙ্গে সঙ্গে। নতুন চৈতন্যে জেগে উঠলেন তিনি। নিজের কর্তব্য স্থির করে ফেললেন। তারপর ছন্দককে বললেন, রথ ঘোরাও, আমি আর কোথাও যাব না।
প্রাসাদে এসে রাজকুমার নিজের চিত্তকে দৃঢ় করলেন। উপলব্ধি করলেন, এখন সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে তিনি নিজেও দুঃখ থেকে মুক্তি পাবেন না। অন্যদেরও মুক্ত করতে পারবেন না। কারণ, ভ্রমণে গিয়ে তিনি যে চারটি দৃশ্য দেখলেন, সে দৃশ্য তাঁর হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করেছে। এই চারটি দৃশ্যকে বৌদ্ধ সাহিত্যে 'চারি নিমিত্ত' নামে অভিহিত করা হয়। চার নিমিত্ত থেকে বন্ধনমুক্ত জীবন 'সন্ন্যাস' অবলম্বনকেই রাজকুমার শ্রেয় মনে করলেন।
আরও দেখুন...